ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী (প্রবন্ধ রচনা) উচ্চমাধ্যমিক বাংলা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবন্ধ রচনা class 12 | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী (প্রবন্ধ রচনা) উচ্চমাধ্যমিক বাংলা | ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচনা
Photo of author
Saheb Roy

Published On:

আজকের পোস্টে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবন্ধ রচনা রচনাটি তোমাদের সাথে শেয়ার করলাম, যেটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে অনেকাংশে সহায়তা করবে। রচনাটি খুব সহজ ভাষায় তোমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এরকম প্রতিনিয়ত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইট Procesta – প্রচেষ্টা ভিজিট করো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জীবনী (প্রবন্ধ রচনা) উচ্চমাধ্যমিক বাংলা

বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, উনবিংশ শতাব্দীর প্রাণপুরুষ, বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগর ছিলেন বাঙালি জীবনের পতিতপাবনী গঙ্গা ও বাংলা গদ্যের জনক। দরিদ্র পরিবারে জন্মে, দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েও বিদ্যাসাগর বাঙালি জাতিকে শিখিয়েছেন আত্মবিশ্বাস, কর্ম ও নিষ্ঠার জোরে এত বড় ব্যক্তিত্বশালী পুরুষ হওয়া যায়। তিনি ছিলেন ‘করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের’ মূর্তিমান বিগ্রহ। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

"অনেক মহৈশ্বর্য্যশালী রাজা রায়বাহাদুর প্রচুর ক্ষমতা লইয়া যে উপাধি লাভ করিতে পারে নাই, এই দরিদ্র পিতার দরিদ্র সন্তান সেই 'দয়ার সাগর' নামে বঙ্গদেশে চিরদিনের জন্য বিখ্যাত হইয়া রহিলেন।" 

তাঁর দ্বিশত জন্মবর্ষে তাঁর সেই অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও অমলিন কীর্তিকথাকে এবং ‘অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্ব’কে নতুন করে স্মরণ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাবার সময় এসেছে।

আরও পড়ুন: সত্যজিৎ রায় জীবনী রচনা

তৎকালীন সমাজ ও চারিত্রিক গুণাবলী

ঈশ্বরচন্দ্র যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে যুগ ছিল-‘Age of reason and rights of man’-এর। কুসংস্কারের অচলায়তনে বাঙালি সমাজ যখন বন্ধ, শাস্ত্রীয় নিয়মের দোহাই দিয়ে কিছু তথাকথিত সমাজপতি যখন সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তখন বিদ্যাসাগর একক চেষ্টায় সেই অচলায়তনের প্রাচীরকে যুক্তির দ্বারা ভেঙে ফেলে মানবত্বের জয় ঘোষণা করলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন অশাস্ত্র, কুশিক্ষা, অশিক্ষার ঘেরাটোপে পড়ে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। তাই তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন-‘বহুজন-হিতায়’র উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন:  শতবর্ষে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী রচনা | Nirendranath Chakraborty Biography in Bengali

জীবনী

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম (১৮২০, ২৬শে সেপ্টেম্বর)। মাতা ভগবতী দেবী ও পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য সন্তান ছিলেন বিদ্যাসাগর, গ্রামের পাঠশালায় তাঁর প্রথম শিক্ষা শুরু। এরপর পিতার সঙ্গে পায়ে হেঁটে আসেন কলকাতায় এবং আসার পথে মাইলপোস্টের সংখ্যা গুণে গুণে গণিতের পাঠ গ্রহণ করেন। কলকাতায় সংস্কৃত কলেজে তিনি ভর্তি হন। প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে, নিজের হাতে রান্নাবান্না করে, রাস্তায় গ্যাসের লাইটে দাঁড়িয়ে ক্লাসের পড়া করে অতি কষ্টে তিনি বিদ্যাশিক্ষা করেন। অসাধারণ মেধা ও কঠোর পরিশ্রম-এই দুয়ের সমন্বয়ে তিনি প্রতি ক্লাসে প্রথম হতেন ও সেজন্য বৃত্তিলাভ করতেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান পণ্ডিতরূপে যোগদান করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২২শে জানুয়ারি তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

শিক্ষা সংস্কার

ঈশ্বরচন্দ্র বাঙালি জাতিকে অশিক্ষার তমসা থেকে জ্যোতির্ময় আলোকে আনতে চেয়েছিলেন। জাতিকে তিনি যুক্তি ও বিচারবোধে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত শিক্ষার। সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠনের শিক্ষা সংস্কার রিপোর্টে তিনি তাঁর শিক্ষানীতিকে দৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। কৃষিজীবী বয়স্ক মানুষের জন্য তিনি কার্মাটারে নাইট স্কুল খোলেন। মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনকে তিনি বৃহৎ বেসরকারি কলেজে পরিণত করেন। হার্ডিঞ্জের পরিকল্পনামতো ১০১টি বঙ্গ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি প্রয়াসী হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন:  প্লাস্টিক দূষণ : সমস্যা ও প্রতিকার - প্রবন্ধ রচনা (উচ্চমাধ্যমিক প্রবন্ধ রচনা)

সাহিত্যকীর্তি

বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী ছিলেন তিনি, এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উপযোগবাদী। তাঁর সাহিত্য চর্চাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়- (১) অনুবাদমূলক ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ইত্যাদি। (২) শিক্ষামূলক ‘বর্ণপরিচয়’, ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা ইত্যাদি। (৩) সমাজসংস্কারমূলক ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব সাহিত্যকীর্তি ইত্যাদি। (৪) লঘু রচনা-‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’ ইত্যাদি। (৫) মৌলিক রচনা প্রভাবতী সম্ভাষণ (বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে রচিত)।

সমাজ-সংস্কারক

মাতা ভগবতীর প্রতি শ্রদ্ধা-ই তাকে নারীমুক্তি আন্দোলনে নিয়োজিত করেছিল। রামমোহন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নারীজাতির প্রতি যে শ্রদ্দা দেখিয়েছিলেন, বিদ্যাসাগর সেই পথেই বিধবা বিবাহ আন্দোলন শুরু করেছিলেন-শাস্ত্রীয় নিয়মের দোহাই দিয়ে সমাজপতিদের বোঝাতে চেয়েছিলেন-বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। তাঁর মতে, অল্পবয়স্কা বিধবারা শাস্ত্রমতে যদি দেবীস্বরূপা হয় তবে সমাজের চারপাশের লোকেরা নিশ্চয় দেবতা। বেন্টিঙ্কের সহায়তায় রামমোহন ‘সতীদাহ প্রথা’ রদ করেছিলেন, বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই ‘বিধবা বিবাহ আইন’ পাশ করিয়ে নেন। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। নিজের খরচে তিনি এক একটি করে বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন এবং এজন্য তাঁর সেসময় খরচ হয়েছিল প্রায় বিরাশি হাজার টাকা। শুধু কি তাই, বিধবা হওয়া থেকে মেয়েদের রক্ষা করতে পুরুষের বহু বিবাহ রদ করতেও তিনি চেয়েছিলেন।

জাতীয়তাবোধ

বর্তমান মেরুদণ্ডহীন বাঙালি জাতির কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বদেশপ্রেমিক। জাতির ও দেশের কল্যাণে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজরা সংস্কৃত কলেজে অস্থায়ী আস্তানা স্থাপন করতে চাইলে বিদ্যাসাগর তার প্রতিবাদ করেন। জাতীয় কংগ্রেসকে তিনি সশস্ত্র আন্দোলনে রূপায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। মা ও দেশের মাটির প্রতি তাঁর টান ছিল সহজাত।

আরও পড়ুন:  বিজ্ঞানের জয়যাত্রা প্রবন্ধ রচনা Class 10

মানবিকতাবোধ

তিনি শুধু বিদ্যার সাগরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন দয়ার সাগর, করুণার সাগর। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ‘দয়ার সাগর’ই বলতেন। পরদুঃখকাতরতা তাঁকে দীন-দুঃখীর চোখের জল মোছাতে সচেষ্ট করেছিল। মায়ের কথাতেই তিনি গ্রামের মানুষের জন্য অন্নসত্র খুলেছিলেন, শীতার্ত মানুষকে গরম বস্ত্র দান করতেন। বহু দাতব্য চিকিৎসালয়ও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রবাসী কবি মধুসূদনকে চরম আর্থিক অনটনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি। দেশাচার ও লোকাচারের ঊর্ধ্বে মানবিকতাকে তিনি মূল্য দিয়েছিলেন বেশি। এ পৃথিবীকে তিনি সাধারণ অবহেলিত মানুষদের বসবাসযোগ্য করে যাওয়ার মন্ত্রে ব্রতী হয়েছিলেন।

উপসংহার

একালেও বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক গুণাবলী আমাদের একমাত্র আদর্শস্থল। সেজন্য নৃপেন্দ্রকৃয় চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন-“আজকের বাঙালীর পক্ষে সবচেয়ে বেশী দরকার হলো, সেই টিকিওয়ালা বাঙালী ইংরেজকে আমাদের প্রতিদিনকার জীবনের ক্ষেত্রে জ্যান্ত করে তোলা।” বিদ্যাসাগরকে উপলব্ধি করতে গেলে, তাঁকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে গেলে প্রয়োজন তার ইস্পাতের মতো চারিত্রিক কাঠামোকে অনুধাবন করা। মধু-কবি নিজের জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন বিদ্যাসাগরের দয়া-দাক্ষিণ্য। তাই তিনি গেয়ে উঠেছিলেন-

'বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে, দীন যে, দীনের বন্ধু।'

-এ কোন উচ্ছ্বাস নয়, বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন এবং তা বর্তমান সময়েও সমান প্রাসঙ্গিক। কারণ তাঁর চিন্তা ও চেতনা, যুক্তি ও বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও পৌরুষ, শিক্ষা ও দীক্ষা, দয়া ও কারুণ্য, মনুষ্যত্ববোধ ও প্রতিবাদী সত্তা এসবের একত্র সমাহার বর্তমান দিনেও দুর্লভ।

অনুসরণে লেখা যায়:

  • নবজাগরণের একজন শ্রেষ্ঠ ঋত্বিক।
  • তোমার প্রিয় মহাপুরুষ। সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগর।
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন ও সাধনা।

Leave a Comment