আজকে procesta.in এর মধ্যে তোমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট শেয়ার করলাম। এই পোষ্টের মাধ্যমে গঙ্গা দূষণ: সমস্যা ও প্রতিকার নিয়ে প্রবন্ধ রচনা তোমাদের সাথে শেয়ার করলাম। এই প্রবন্ধ রচনাটি বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জন্য সাহায্য করবে।
গঙ্গা দূষণ ও তার প্রতিকার
ভূমিকাঃ গঙ্গা ভারতের একটি আদর্শ ও পবিত্র নদী। গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে ভারতীয় মানসে তৈরি হয়েছে নানা পৌরাণিক কাহিনী, গল্প, গাথা আরও কত কী। গঙ্গাকে ভারতের অন্তরাত্মাও বলা যায়। তার তীরে তার আশীর্বাদধন্য হয়ে তৈরি হয়েছে অজস্র শহর, নগর, বন্দর। তাকে কেউ কেউ বলেছেন কলুষনাশিনী, কেউ বলেছেন পতিতপাবনী, আবার কেউ কেউ বলেছেন পুতসলিলা জাহ্নবী। আজও তার অবগাহনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মনকে কলুষ মুক্ত করে। তার পুত সলিলে শত শত দেবদেবীর পূজা সমাপন করা হয়। তিনি আজও অনন্যা, তার রূপে এবং গুণে। ধর্মপ্রাণ মানুষ আজও তার স্পর্শ কামনা করে, তার স্পর্শে মাথা নত করে, তার প্রতি এই শ্রদ্ধা অন্য কোনো নদনদীই আশা করতে পারে না। তাই এই নদী পতিত পাবনী গঙ্গা।
দূষণের কারণ: ভারতীয় সভ্যতা গঙ্গানদীর কল্পেলিত প্রাণধারার লালিত। ভারতীয় সভ্যতার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটেছে গঙ্গার সমৃদ্ধ অববাহিকায়। তাকে আশ্রয় করেই বিকাশ ঘটেছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন। এমন কি অর্থনৈতিক জীবনের বিকাশেও এর অবদান অনস্বীকার্য। সেই কারণে এই নদীর তীর ভূমি এক সময় ঋষি ও আশ্রমিকদের মিলিত সামগানে মুখরিত হয়ে উঠতো তেমনি এরই পারে পারে বিভিন্ন প্রদেশে গড়ে উঠেছে ১১৪টি বড় শহর বন্দর। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই নদী আর নিজেকে কলুষমুক্ত রাখতে পারেনি। একদিন সে সত্যই ছিল পাপনাশিনী, দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু সেটা আজ আর স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়। আজ তার শরীর এককথায় দূষিত, কলুষিত। মানুষ তার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাকে ব্যবহার করছে নোংরা ফেলার জায়গা বা ডাস্টবিন হিসেবে। গঙ্গা দূষণের মূল কারণগুলি হল –
- ভারত ও বাংলাদেশের (পদ্মা আববাহিকা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল) অবস্থিত গঙ্গার বিস্তৃত অববহিকা অঞ্চল অত্যন্ত উর্বর এবং সেই হেতু ঘনবসতিপূর্ণ; প্রায় ৮০ কোটি লোকের বাস এখানে। স্বাভাবিকভাবেই সূচিত হল গঙ্গা দূষণের মূল কারণ।
- গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের অবিরাম ভূমিক্ষয় তার জলপ্রবাহকে করে চলেছে ক্রমাগত কর্দমযুক্ত। মূল কারণ অতিরিক্ত জনবসতির কারণে অরণ্যের ক্রমবিলীয়মানতা।
- গঙ্গা নদীর সমগ্র অববাহিকা অঞ্চলের উভয় তীরের প্রায় ৭০০ ছোট বড় শহরের পয়ঃপ্রণালী নিঃসৃত নোংরা জল গঙ্গায় ফেলা হয়।
- এর উভয় তীরে জুড়ে রয়েছে হাজার হাজার ছোট বড় কলকারখানা। এইসব শিল্পকারখ ানা গুলির পরিত্যক্ত বস্ত্র, চর্ম, প্লাস্টিক, রবার ও রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ সমন্বিত নর্দমার জল কোথাও একেবারে অশোধিত অবস্থায়, কোথাও বা নামমাত্র শোধিত অবস্থায় গঙ্গাবক্ষে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে।
- কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক শেষ-পর্যন্ত এখানে এসে পড়ে।
- গঙ্গার দু’পারের বসতির কাপড় কাচা, গরু-মোষ স্নান করানো ইত্যাদি
- গঙ্গার দু’পারের যে সব ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসব হয় তার বর্জ্য পদার্থ গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হয়।
- গঙ্গায় যে সব জাহাজ, স্টিমার চলে তার পোড়া পেট্রল, ডিজেল সব গঙ্গায় ফেলা হয়। এ ছাড়া গঙ্গার পাড়ে মলমূত্র ত্যাগ, গঙ্গায় মরা জীবজন্তু নিক্ষেপ এমনকি মানুষের মৃতদেহ পর্যন্ত গঙ্গায় নিক্ষিপ্ত হয়। এই সব বিভিন্ন কারণে পবিত্র ও পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা কার্যত একটি অতি-বৃহৎ নর্দমায় পর্যবসিত হয়েছে।
দূষণের ফলাফল: গঙ্গা দূষণের কুফল বলতে যেটা প্রথমেই বলতে হয় সেটি হচ্ছে আমরা নিজেরা আমাদের মৃত্যু ডেকে আনছি প্রতিনিয়ত। তার বিষপ্রবাহে নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ একর জমির শস্য, গবাদি পশু, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। আজ মানুষের দুরারোগ্য ব্যাধির কারণ হচ্ছে গঙ্গার এই দূষিত জল। এছাড়া নষ্ট হচ্ছে নদীর নাব্যতা। নদীগর্ভে ক্রমশ সঞ্চিত হচ্ছে নানা দূষিত পদার্থ। তাদের স্তর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থার, ব্যাবসা-বাণিজ্যের। এতগুলি কুফল জেনেও যদি আমরা আজ মনে করি গঙ্গা দূষণ আমাদের অধিকার তাহলে মৃত্যুর হাত থেকে স্বয়ং ঈশ্বরও আমাদের বাঁচাতে পারেন না। আমরা বোধ করি জেগে ঘুমোচ্ছি। তাই জাগানো খুব মুশকিল।
গঙ্গা দূষণ রোধের উপায়: গঙ্গা দূষণ রোধ করার জন্য বেশ কিছু উপায় বা পন্থা ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন –
- নদীর দুই পারের বিভিন্ন বসতির প্রয়ঃপ্রণালী নিঃসৃত নোংরা জল, জঞ্জাল এবং কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যপদার্থ যাতে সরাসরি গঙ্গায় না পড়ে সর্বাগ্রে তার ব্যবস্থা করা।
- নোংরা জল শোধনের জন্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো।
- পয়ঃপ্রণালী ও শিল্প কারখানার বাহিত পরিশোধিত জল নদীতে না ফেলে সেই জল সেচের কাজে লাগানো। কারণ এতে জৈব সার থাকে।
- কম খরচে নদী তীরবর্তী বস্তি ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে শৌচালয় স্থাপন।
- ঘাটগুলির সংস্কার ও নদী তীরবর্তী এলাকাগুলির বিকাশ সাধন।
- নদীর জলে যে সব জীব দূষণের কারণে কমে গেছে তাদের বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থা করা।
- নদীর জলের মান নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

প্রতিকারের উপায় ও প্রচেষ্টা (গঙ্গা এ্যাকশন প্ল্যান): গঙ্গা দূষণের প্রকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। কখনও সেটা সরকারি পর্যায়ে, আবার কখনও সেটা বেসরকারি চেষ্টায়। কিন্তু চেষ্টা চলছে অবিরাম। গঙ্গা দূষণ প্রতিরোধের নিমিত্ত গঙ্গা এ্যাকশন প্লানের কথা আজ প্রায় সকলের মুখে মুখে। একটু পিছিয়ে গিয়ে বলতে হয় ১৯৮৫ সালে আমাদের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী প্রথমে ঘোষণা করেন ‘কেন্দ্রীয় গঙ্গা অথরিটি’ গঠনের কথা। পরে সেটি পরিবেশ দপ্তরের অধীনস্থ হয় এবং গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি নির্দেশ দেন এই কমিটিকে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের গঙ্গা দূষণমুক্ত করার যে পরিকল্পনা তারই কর্মসূচির নাম – দেওয়া হয় ‘গঙ্গা এ্যাকশন প্ল্যান’।
আরও পড়ুন: চন্দ্রযান ৩ প্রবন্ধ রচনা
যাইহোক এই প্রচেষ্টা আজও বর্তমান। এর জন্য প্রচুর সরকারি আর্থিক সহযোগিতাও পাওয়া যায়। এ তো গেল সরকারি উদ্যোগ। – অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরণের আরও পরিকল্পনা। যেমন নালা তৈরি করা, – কূপ খনন করা, পাম্প বসানো, ময়লা নিষ্কাশনের জন্য কারখানা তৈরি করা ইত্যাদি। এছাড়াও যেটা বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে হয় সেটি হচ্ছে এ ব্যাপারে জনমত তৈরি করা। প্রতিটি স্তরে মানুষকে বোঝানো, কারখানাগুলিকে সচেতন করা, স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলা ইত্যাদি। যদি এ সমস্তগুলিকে সঠিক -ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে পারি তবেই গঙ্গা আবার দুষণহারিণী হবে এটা আশা করা যায়।
গঙ্গা দূষণ মুক্ত করার গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগসমূহ
গঙ্গা নদী ভারতের অন্যতম পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে শিল্পবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য ও অন্যান্য দূষণের কারণে গঙ্গার পানির গুণমান ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। এই নদী সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ভারত সরকার বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
২০০৯: জাতীয় গঙ্গা নদী অববাহিকা কর্তৃপক্ষ (NGRBA)
২০০৯ সালে গঙ্গা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকার National Ganga River Basin Authority (NGRBA) গঠন করে। এটি একটি উচ্চপর্যায়ের সংস্থা, যার নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এই কর্তৃপক্ষ গঙ্গা দূষণ প্রতিরোধ, পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীর জলগুণমান উন্নত করার চেষ্টা চালায়।
২০১৪: নমামি গঙ্গে কর্মসূচি
২০১৪ সালে গঙ্গা নদীকে দূষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার “নমামি গঙ্গে” (Namami Gange) কর্মসূচি চালু করে। এটি একটি সমন্বিত পরিকল্পনা, যার অধীনে নদীর দূষণ কমানো, নদীর অববাহিকাগুলোর পুনরুজ্জীবন এবং নদীর তীরবর্তী শহর ও গ্রামগুলোর স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করার কাজ করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে আধুনিক বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র স্থাপন, নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ড্রেজিং এবং গঙ্গার ঐতিহ্য সংরক্ষণের মতো কার্যক্রম চালানো হয়।
২০২২: নমামি গঙ্গে মিশন-II
নমামি গঙ্গে কর্মসূচির সফলতার পর ২০২২ সালে “নমামি গঙ্গে মিশন-II” চালু করা হয়। এই পর্বে গঙ্গা নদীর পাশাপাশি তার উপনদীগুলোরও সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আরও কার্যকর প্রযুক্তি ব্যবহার করে নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণকে সংযুক্ত করে গঙ্গার দীর্ঘমেয়াদী টেকসই ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার: কিংবদন্তী যে গঙ্গা এক সময় ষাট হাজার সাগর সন্তানের জীবন দান করেছিলেন। আর আমাদেরও রক্ষা করে চলেছেন তাঁর জন্মলগ্ন থেকেই। সুতরাং কল্যাণকামী মানুষের একমাত্র কামনা হওয়া উচিত গঙ্গা আমাদের পতিতপাবনী, কলুষনাশিনী হোক। গঙ্গা রক্ষা করুন আমাদের সকলকে, সমগ্র ভারতকে, আমাদের আগামী প্রজন্মকেও বাঁচান।









